‘লকডাউন–শাটডাউন’ করে করোনা থেকে বাঁচা যাবে না। সত্যি সত্যি যদি কারফিউ দেওয়া যেত শহর থেকে গ্রামে, পঞ্চগড় থেকে বান্দরবান প্রতিটি জনপদে, তাহলে হয়তো ছয় সপ্তাহ পরে সংক্রমণ অনেক কমে যেত। কিন্তু আবারও যখন সবকিছু খুলে দেওয়া হবে, আবারও সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। কাজেই ‘লকডাউন’ সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। এটা কেবল করোনার গ্রাফকে অনুভূমিক করে দেয়, তাতে চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর একবারে অতিরিক্ত চাপ এড়ানো যায়। কিন্তু রোগশোক–মৃত্যু চলতেই থাকে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিবেশে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন কোনোটাই বাস্তব নয়। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় লোকে চলে নিজের গাড়িতে। বাড়িগুলো আলাদা। যার যার ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে তারা, গাড়িতে বসেই কেনাকাটাও সারতে পারে। লোকসংখ্যার ঘনত্ব কম। আমরা থাকি গাদাগাদি–ঠাসাঠাসি করে। এখানে সঙ্গনিরোধের সুযোগ কোথায়?
আর কত দিনই–বা সবকিছু বন্ধ করে রাখা যাবে? ইউনিসেফ ও ইউনেসকো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে বলেছে। স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় যে কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব বের করা কঠিন কাজ!
আর কত দিনই–বা সবকিছু বন্ধ করে রাখা যাবে? ইউনিসেফ ও ইউনেসকো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে বলেছে। স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় যে কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব বের করা কঠিন কাজ! সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সজীব গ্রুপের কারখানায় আগুনে যে অর্ধশতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে, সেখানে নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় আছে অনেক শিশু-কিশোর। নারায়ণগঞ্জে ঘটনাস্থল ঘুরে এসে প্রথম আলোয় দুটো মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ। তিনি বলেছেন, এই শিশুরা কারখানায় আসত না, যদি না করোনার কারণে তাদের স্কুল বন্ধ থাকত, তাদের অভিভাবকেরা কাজ না হারাতেন!
দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর প্রায় ১২ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী দেড় বছর ধরে বেতনহারা হয়ে কেউ কচু বিক্রি করছেন, কেউ কাপড় ইস্তিরি করছেন, সেসব খবর ধরে আগে প্রথম আলোয় ২ জুলাই আমি কলাম লিখেছি। এটা পড়ে শিক্ষকেরা আমাকে ফোন করেছেন, কেউ বলেছেন, বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের কথাও লিখুন। পরিবহন বন্ধ থাকলে মালিক-শ্রমিকেরা কেমন করে পরিবার-পরিজনের মুখে অন্ন তুলে দেন! ঢাকার এক রেস্তোরাঁর মালিক বলছেন, গুলশানে মাসিক চার লাখ টাকা ভাড়ায় বাড়ি নিয়ে তিনি রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন। ১৬ মাসে ৬৪ লাখ টাকা শুধু বাড়িভাড়া বকেয়া হয়েছে, কর্মচারীদের প্রথমে কিছুদিন অর্ধেক বেতন দিয়ে এখন সেটা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন। আশায় আছেন, আবার সবকিছু খুলে দেওয়া হবে! এই আশায় প্রতি মাসে তাঁর ক্ষতির অঙ্ক বেড়েই যাচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো পুরো দেশকে করোনারোধক টিকার আওতায় আনা। প্রথম আলোয় লেখা হয়েছে, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে চান। সে ক্ষেত্রে আরও প্রায় ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। টিকা লাগবে আরও ২৪ কোটি।
আগামী ১২ মাসে অন্তত ১২ কোটি মানুষকে ২৪ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। বাংলাদেশে রোজ ৭ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার ক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের আছে। মানে মাসে দুই কোটি ডোজ টিকা আমরা দিতে পারব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভ্যাকসিন হিরো’ খেতাব পেয়েছেন ২০১৯ সালে, জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।
এখন দরকার প্রতি মাসে দুই কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করা। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। জুলাই মাসের শেষ দিকে বা আগস্ট মাসে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেশে আসার সম্ভাবনা আছে। তাহলে যে ১৫ লাখ মানুষ এই টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে পরের ডোজের আশায় বসে আছেন, তাঁরা দ্বিতীয় ডোজ পেয়ে যাবেন। এ মুহূর্তে সব মিলিয়ে দেশে টিকার মজুত আছে ৫৮ লাখ ৫৪ হাজারের কিছু বেশি। আরও টিকা আসছে। হয়তো আগামী এক মাসের মধ্যে দেশে এক কোটি লোক টিকা পেয়ে যাবেন, দুই মাসের মধ্যে দেড় কোটি! কিন্তু বাকি ১১ কোটি লোক টিকা পাবেন কবে, কীভাবে?
আমরা পারব না, তা বলছি না। বলছি, সরকার আমাদের রোডম্যাপ দিক, বলুক, এভাবে আমরা প্রতি মাসে দুই কোটি ডোজ টিকা আনব, ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে আমরা ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্পন্ন করে ফেলব। সরকারকে একটা পরিকল্পিত কর্মসূচি প্রণয়ন ও পেশ করতে হবে। জনগণের সামনে হাজির করতে হবে।
কোটি কোটি টিকা আমরা কোথায় পাব? কে দেবে আমাদের? একটা উপায় হতে পারে, দেশে টিকা উৎপাদন। সেটা সরকারি কারখানায় হতে পারে, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে হতে পারে, সরকারের কঠোর নজরদারির ভেতরে বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানও করতে পারে। এ মুহূর্তে যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে ওষুধ উৎপাদনে কাজ শুরু করা হয়, তা বাস্তবায়িত হতেও তো কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে।
আমরা আর কত দিন করোনার কবলে পড়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে পারব? আবার সবকিছু খুলে দিয়ে প্লেগের ইঁদুরের মতো মারা যাব, তাই–বা কী করে হতে দেওয়া যায়!
টিকা না দিলে স্কুল-কলেজ খুলবে না, কারখানা বন্ধ রাখতে হবে, রাস্তাঘাট বন্ধ রাখতে হবে, মানুষ মারা যাবে করোনায়, মানুষ মারা যাবে বেকারত্বের কারণে! কিন্তু আমরা তা হতে দেব না। বাংলাদেশ পারবে। করোনাযুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।
চিকিৎসাব্যবস্থাকে প্রস্তুত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি দূর করে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ৬৪ জেলায় অক্সিজেন-ব্যবস্থা নিয়ে গিয়ে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করতে হবে। অক্সিজেন সরবরাহ সপ্রতুল রাখতে হবে। উপজেলা হাসপাতালগুলোকে সক্রিয় ও সক্ষম করে তুলতে হবে। ‘লকডাউন’ করতে হবে। এসবই আশু করণীয়। কিন্তু এসব হলো আক্রান্ত হওয়ার পরে উপশমের জন্য। উপশমের চেয়ে প্রতিরোধ সব সময়ই ভালো। আর করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো সর্বজনীন টিকাদান। সরকারের নিজের পরিকল্পনামতো ১৩ কোটি মানুষকে ২৬ কোটি ডোজ টিকাদান। এটা করতে হবে দ্রুত। টিকাদানে সাফল্যের একটা সূত্র হলো টিকা দিতে হয় একযোগে। সে জন্য একসঙ্গে দেশের সব জায়গায় একটু একটু করে টিকা দেওয়ার চেয়ে একটা জায়গায় সবাইকে টিকা দিলে বেশি সুফল আসবে। এসবই ভালো বলতে পারবেন, সময় ও স্থান ধরে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারবেন বিশেষজ্ঞরা। টিকা দ্রুত না দেওয়া গেলে নতুন ভেরিয়েন্ট এসে যাবে। টিকা কার্যকারিতা হারাবে। আবার এক বছর পরে বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজ দেওয়ার সময়ও এসে যেতে পারে।
কাজেই সরকারকে বলব, এ মুহূর্তের কর্তব্য তালিকায় এক নম্বর অগ্রাধিকার হলো দেশের বেশির ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা। সেটা করার জন্য রোডম্যাপ চাই, পরিকল্পনা, কর্মসূচি, দিকনির্দেশনা চাই।
টিকা না দিলে স্কুল-কলেজ খুলবে না, কারখানা বন্ধ রাখতে হবে, রাস্তাঘাট বন্ধ রাখতে হবে, মানুষ মারা যাবে করোনায়, মানুষ মারা যাবে বেকারত্বের কারণে!
কিন্তু আমরা তা হতে দেব না। বাংলাদেশ পারবে। করোনাযুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। কীভাবে জিতব, সেই রোডম্যাপ সরকারের কাছ থেকে আমরা পেতে চাই।
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
Leave a Reply