কলেজের কোনো কোনো শিক্ষক বলেছেন, অধ্যক্ষ কলেজটিকে নিজের টাকা বানানোর যন্ত্রে পরিণত করেছেন। তঁারা তদন্তের ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা চান।
অবশ্য অভিযুক্ত অধ্যক্ষ গোলাম ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেছেন, কলেজের কিছু লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁর পেছনে লেগেছে। তাঁরাই কলেজের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এসব করাচ্ছেন। যে তিনটি ফ্ল্যাটের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে একটি অধ্যক্ষ হওয়ার আগেই বুকিং দিয়েছিলেন। তবে বাকি দুটি দু-তিন বছর হলো বুকিং দেওয়া হয়েছে, যা তাঁর আয়কর নথিতে আছে। শ্বশুরের চিকিৎসার নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগও মিথ্যা।
অবশ্য তদন্ত কমিটি বলছে, ২০১৮ সালে অধ্যক্ষ শ্বশুরের চিকিৎসার জন্য কলেজ তহবিল থেকে পাঁচ লাখ গ্রহণ করেন। তদন্ত চলাকালে সেই টাকা অধ্যক্ষ তহবিলে ফেরত দেননি, যা আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলেজের প্রভাষক মো. গোলাম ওয়াদুদকে কলেজের উপাধ্যক্ষসহ জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের ডিঙিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ইসহাক হোসেনকে অবসর দেখিয়ে পরিচালনা কমিটির অনুমোদন ছাড়াই কাজটি করেন কলেজ পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত সাংসদ আসলামুল হক। কমিটি বলছে, গোলাম ওয়াদুদকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব দেওয়া বিধিসম্মতি হয়নি। তৎকালীন সভাপতি নিয়মবহির্ভূতভাবে একক সিদ্ধান্তে এই দায়িত্ব দেন। পরের বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থেকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান তিনি। কমিটি বলেছে, বিধিবহির্ভূতভাবে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় অধ্যক্ষ নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি।
সাবেক অধ্যক্ষ ইসহাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে অন্যায়ভাবে সরানোর কারণে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ সুবিধার টাকা তুলতে পারেননি। তিনি চান, কলেজের অনিয়মের যথাযথ ব্যবস্থা হোক।
গোলাম ওয়াদুদ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বেতনের সরকারি অংশের বাইরেও কলেজ থেকে ৫৫ হাজার ৬০০ টাকা প্রতি মাসে বেতন হিসেবে গ্রহণ করেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, অধ্যক্ষের মিরপুর এলাকায় অনেক দাম দিয়ে যে তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, তার মূল উৎস কলেজের টাকা। তদন্তে বলা হয়, অধ্যক্ষের তিনটি ফ্ল্যাট থাকার অভিযোগ প্রমাণিত। তবে টাকার উৎসের তথ্য সরবরাহ করেননি। তিনি ২০১৮ সালের কোরবানির ঈদের সময় মিরপুরের স্বপ্ননগর আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটের টাইলস কেনা বাবদ সহকারী হিসাবরক্ষকের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নগদ গ্রহণ করেন, যার জমার তথ্য তদন্তকালে দেখাতে পারেননি অধ্যক্ষ।
নাটোরে গ্রামের বাড়িতেও অধ্যক্ষের তিনতলা ভবন নির্মাণাধীন আছে। বাড়িটি তিন ভাইয়ের যৌথ মালিকানায় বলে কমিটিকে জানান অধ্যক্ষ। কমিটি দেখেছে, ২০১৮ সালে রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময়ে বাড়ির কাজের জন্য কলেজ থেকে নগদ তিন লাখ টাকা নেন অধ্যক্ষ।
অভিযোগের ভিত্তিতে অধ্যক্ষ লিখিতভাবেই তদন্ত কমিটিকে জানান, ডাকঘরের সঞ্চয়পত্রে লাভসহ সাত লাখ টাকা আছে, আর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ আছে তিন লাখ টাকা।
সম্মানী ও নির্মাণকাজে যত অনিয়ম
নির্মাণকাজে ২০১৩ সালের ২৬ জুলাই পাথর কেনা বাবদ মোট ব্যয় দেখান ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭২০ টাকা। এই ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, একই তারিখে একই কাজের ৫৯ হাজার ১৪৮ টাকা এবং ৫৭ হাজার ২৪০ টাকার আরও দুটি ভাউচার পাওয়া গেছে। কিন্তু বিলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো স্বাক্ষর নেই।
কমিটি বলছে, দরপত্র ছাড়াই ১ হাজার ৬০০ বস্তা সিমেন্ট কিনে ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং কলেজের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে ১০ লাখ ১৭ হাজার টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষা সফরে ব্যয় করা টাকার মধ্যে ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা এবং ২০১৮ সালে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী পথসভা অনুষ্ঠানে ব্যয় করা ১৮ লাখ টাকার বিলকেও আত্মসাতের শামিল বলা হচ্ছে। কমিটি বলছে, শিক্ষার্থীদের পোশাক তৈরি বাবদ ১০ লাখ টাকার ভুয়া বিল দাখিল করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব খাতের ভ্যাট বাবদ ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের আয়কর বাবদ ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে দিতে বলেছে।
Leave a Reply