গাজায় নির্বিচার হামলায় ইসরায়েলকে সামরিক সহযোগিতা ও নেতানিয়াহুর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে খোদ নিজের দলেই প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন বাইডেন। আবার তাঁর দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করছেন নেতানিয়াহু। দুই দিকেই চাপে পড়ে বিপদে বাইডেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গাজার চলতি যুদ্ধ নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছেন। খোদ তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টির একাংশ এখন ইসরায়েলের প্রতি তাঁর নিঃশর্ত সমর্থনকে প্রত্যাখ্যান করছে। আন্তর্জাতিকভাবেও তিনি একাকী হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর মতভেদ কার্যত প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। বাইডেন চান, গাজার যুদ্ধ শেষ করে ইসরায়েলি বাহিনী দ্রুত নিজ সীমানায় ফিরে যাক। কিন্তু নেতানিয়াহু চান গাজায় স্থায়ীভাবে ইসরায়েলি সামরিক অবস্থান পোক্ত করতে। এটি তাঁর রাজনৈতিক ভরাডুবি থেকে বাঁচার একটি ঘুঁটি হতে পারে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামাসের অভাবনীয় হামলার পর প্রথম যে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ান, তিনি হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি আজীবনই ইসরায়েলপন্থী। এটি শুধু তাঁর রাজনীতি নয়, তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসেরও একটি অংশ—এমন কথা তিনি নিজেই বলেছেন। নিজে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের হলেও তিনি বিশ্বাস করেন, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখা তাঁর দায়িত্ব। টাইম সাময়িকীর ভাষায়, বাইডেনই হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় ইসরায়েলপন্থী প্রেসিডেন্ট’।
বাইডেনের এই অবস্থান তাঁকে ইসরায়েলে অসম্ভব জনপ্রিয় করলেও নিজ দেশে তিনি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ইসরায়েলের বেপরোয়া বোমাবর্ষণের ফলে বেসামরিক মানুষ, বিশেষত নারী ও শিশু, বিপুল সংখ্যায় হতাহত হচ্ছে। এসব খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই ব্যাপক প্রতিবাদ ওঠে। প্রতিবাদ ওঠে বিশ্বজুড়ে।
জাতিসংঘের ভেতরে অবিলম্বে ‘মানবিক’ যুদ্ধবিরতির দাবি উঠলে বাইডেনের নির্দেশে শুধু সে প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া হয়নি, হামাস নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর এই অবস্থান শুধু আরব ও বৈশ্বিক দক্ষিণের সরকারগুলোকে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদেরও অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। ভেতরের খবর জানেন এমন সূত্রগুলো জানাচ্ছে, হোয়াইট হাউসের এই অনড় অবস্থান নিয়ে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড তাঁর অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেছেন।
বিষয়টি বাইডেনের নজর এড়িয়ে গেছে, তা নয়। তিনি ইসরায়েলের কথা উল্লেখ করে এক ঘরোয়া বৈঠকে মত প্রকাশ করেন, বেপরোয়া বোমাবর্ষণের কারণে বিশ্বে ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন কমে আসছে। তাঁর এ কথা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্র পাশে আছে বলেই ইসরায়েল এমন বেপরোয়া অবস্থান নিতে পেরেছে।
আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ জানা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে হোয়াইট ফসফরাস জাতীয় বিস্ফোরক সরবরাহ করেছে। শুধু কি তাই, ইরান বা লেবাননের হিজবুল্লাহ যাতে টুঁ–শব্দ না করতে পারে, সে জন্য তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিমানবাহী দুটি নৌযান পাঠিয়েছে, সঙ্গে ৭০০ নৌসেনা। কংগ্রেসকে এড়িয়ে জরুরি ভিত্তিতে ট্যাংকে ব্যবহারের জন্য গোলাবারুদ পাঠানো হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই যুদ্ধ যতটা ইসরায়েলের, ততটা যুক্তরাষ্ট্রেরও।
নিরাপত্তা পরিষদ
কূটনৈতিক বিপর্যয়ের বাস্তবতা হিসাবে এনে যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে নিরাপত্তা পরিষদে গত শুক্রবার গৃহীত এক প্রস্তাবে ‘আশু ত্রাণ পৌঁছে দিতে যুদ্ধবিরতি’র সমর্থনে ভেটো প্রদানের বদলে ভোটদানে বিরত থাকে। এর ফলে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য যেমন অক্ষত থাকল, তেমনি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর দাবির প্রতিও সম্মান দেখানো হলো। যাঁর দূতিয়ালিতে বিস্তর কাঠখড় পোড়ানোর পর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে, জাতিসংঘে নিযুক্ত আরব আমিরাতের সেই রাষ্ট্রদূত স্বীকার করেছেন—এটি একটি দুর্বল প্রস্তাব। আরব ও কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশ চেয়েছিল অবিলম্বে অনির্দিষ্টকালের জন্য যুদ্ধবিরতি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
মূল খসড়া প্রস্তাবে সংঘর্ষ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ইসরায়েলের চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাগড়া দিয়ে জানায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে তাতে লাভ হবে হামাসের। যুদ্ধ বন্ধ না হলে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু যে বন্ধ হবে না, সে ব্যাপারে অবশ্য ওয়াশিংটন কোনো রা করেনি।
আনুগত্যের কঠিন মূল্য
গাজা যুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট হতাহতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শুধু নিহত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। এই সময়ে যে পরিমাণ বিস্ফোরক বিমানযোগে নিক্ষেপ করা হয়, মার্কিন গণমাধ্যমের হিসাব অনুসারে তা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত দুটি আণবিক বোমার সমশক্তিসম্পন্ন। নির্বিচার যে বোমা ফেলা হয়েছে, তার ৪০ শতাংশ ‘আনগাইডেড’ বা অনির্দেশিত হওয়ায় মানুষ মরেছে দেদার। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর গাজায় অক্ষত এমন একটি বাড়িও নেই। সচল এমন একটি হাসপাতাল নেই। খাদ্য নেই, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই। জাতিসংঘ থেকে বলা হয়েছে, শিশুদের জন্য গাজা হচ্ছে এক কবরস্থান।
গোড়ার দিকে মার্কিন গণমাধ্যম শুধু হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার ওপর নজর দিয়েছিল। পাল্টা হামলায় ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ কার্যত উপেক্ষা করেছিল তারা। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম ও আল–জাজিরা টিভির কারণে সে কথা গোপন থাকেনি। আরব অথবা পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যাপক প্রতিবাদের আগে খোদ যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ ওঠে।
সাম্প্রতিক জনমত জরিপ থেকে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির পক্ষে (৬১ শতাংশ)। ডেমোক্র্যাট ও স্বতন্ত্র ভোটাররা তো বটেই, এমনকি রিপাবলিকানদের মধ্যেও ৪৯ শতাংশ মানুষ যুদ্ধবিরতির পক্ষে রায় দিয়েছেন। কংগ্রেসের ভেতরে ডেমোক্র্যাট সদস্যদের একাংশ বিশেষ করে প্রগতিশীল অংশ যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের দাবির পাশাপাশি কঠোর ভাষায় বাইডেন প্রশাসনের ইসরায়েল-তোষণ নীতির সমালোচনা করেছেন। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ইসরায়েলকে ‘চরমপন্থী’ আখ্যায়িত করে গাজায় বিশেষত হাসপাতালে নির্বিচার বোমাবাজিকে ‘অবর্ণনীয় অপরাধ’ বলে চিহ্নিত করেন।
বাইডেনের জন্য উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েল প্রশ্নে মার্কিন নাগরিকদের বিশেষ করে অনূর্ধ্ব–৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে নিঃশর্ত সমর্থনের প্রতিবাদ উঠেছে। একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ১৯-২৯ বছর বয়সী মার্কিনদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ নিজেদের ইসরায়েলপন্থী মনে করেন। অন্যদিকে ২৮ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে জানিয়েছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব মার্কিনদের অবস্থান ঠিক উল্টো।