ত্রাণ অপ্রতুল, চাহিদার কেন্দ্রীয় কোনো হিসাব নেই। সরকারসহ সহায়তাদানকারী ব্যক্তি, সংগঠন বা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। অনেকে কিছুই পাচ্ছেন না, আবার কেউ একাধিকবার পাচ্ছেন। করোনার এই বন্ধে রাজধানীর ভুখা মানুষের সহায়তা জোগানোর কাজটি দেড় মাসেও গুছিয়ে ওঠেনি।
নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাধারণ আর লকডাউনে কর্মহীন ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসনের (ডিসি) মাধ্যমে ধাপে ধাপে ত্রাণ বরাদ্দ করছে।
রাজধানীতে পরিবারপ্রতি পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজি আলুর এই ত্রাণ যাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে। প্রথম ধাপের ত্রাণ মানুষের কাছে যেতে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ চলে আসে। করপোরেশন ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে তালিকা করে ত্রাণ দিচ্ছে।
ঢাকা উত্তর বা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে কোনো কেন্দ্রীয় তালিকা নেই। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা UK বাংলা News কে বলেন, বরাদ্দের তুলনায় অভাবী মানুষ বেশি। উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান যেমন বললেন, এলাকায় ১২ হাজারের মতো পরিবারের ত্রাণ দরকার। প্রাপ্ত বরাদ্দে কুলাবে বড়জোর এর অর্ধেকের।
উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যথাক্রমে সাত ও আট দফায় বরাদ্দ গেছে। ৫ মে পর্যন্ত একেক করপোরেশন চাল পেয়েছে প্রায় দেড় হাজার মেট্রিক টন। নগদ পেয়েছে ৭৪ লাখ করে টাকা, যার ৮ লাখ শিশুখাদ্যের জন্য। সব টাকা দিয়ে পরিবারপ্রতি দুই কেজি আলু কেনা হচ্ছে। ঢাকা জেলা প্রশাসন দুই করপোরেশনকে প্রথম বরাদ্দের চিঠি দেয় ৭ এপ্রিল। তারপর করপোরেশন আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে বরাদ্দ ভাগের চিঠি দেয়। সেখান থেকে উপ-বরাদ্দের চিঠি যায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দপ্তরে। মানুষের কাছে সরকারি ত্রাণ প্রথম পৌঁছায় ১৭ এপ্রিল।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার UK বাংলা News কে বলেন, প্রাপকদের তালিকা কাউন্সিলরেরা ঠিক করছেন।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, চলতি মে মাসে প্রতি জেলায় ৫০ লাখ পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এক লাখ পরিবার এই সুবিধা পাবে।
চাল-আলু আর অপ্রতুলতা
কল্যাণপুর পোড়া বস্তির বাসিন্দা জাহানারা বেগম UK বাংলা News কে বলেন, ‘পাঁচজনের সংসারে পাঁচ কেজি চালে কত দিন চলে? আর চাল, আলু দিয়ে কী পেট ভরব?’ তিনি বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। স্বামী ভ্যানচালক। গত দেড় মাস ধরে দুজনেই বেকার।
দুই সিটি করপোরেশনের ছয়জন কাউন্সিলর UK বাংলা News কে বলেন, অন্তত এক মাসের রসদ না জোগালে মানুষজন ঘরের বাইরে বেরোবেই।
সরকার পরিবারপ্রতি পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজি আলু দিচ্ছে। ত্রাণ বস্তিমুখী। তালিকা তৈরির পাইলট উদ্যোগ চলছে।
ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজের চাহিদা সরকার আমলে নিচ্ছে না। কিন্তু পুষ্টিবিদ ডা. এস কে রায় UK বাংলা News কে বলেন, পুষ্টি ঠিক রাখতে শর্করার পাশাপাশি খাদ্যে আমিষ, ভিটামিন, স্নেহ ও খনিজ উপাদান দরকার। না হলে মানুষ অন্য রোগে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৪ সালের বস্তিশুমারি বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বস্তি আছে। বস্তিবাসীর সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ। তবে বেসরকারি সংস্থা নগর গবেষণা কেন্দ্র ২০০৫ সালের এক শুমারিতে বস্তির জনসংখ্যা পেয়েছিল ৩৫ লাখ।
পোড়া বস্তি, মহাখালীর কড়াইল আর পল্লবীর বেগুনটিলা বস্তির কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশনের (সিবিও) নেতারা UK বাংলা News কে বলেছেন, তাঁদের অনেকেই সরকারি ত্রাণ পাননি।
সমন্বয়হীনতা ও উপেক্ষা
ঢাকায় সবচেয়ে বড় অভিযোগ ত্রাণের বণ্টন আর না–পাওয়া নিয়ে। মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বাইরে উত্তর সিটি করপোরেশন নিজস্ব তহবিল থেকে ত্রাণ বাবদ ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ত্রাণ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, ঢাকা ওয়াসা বা মহানগর পুলিশ। আছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, দানশীল ব্যক্তি আর ব্র্যাকসহ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন।
কল্যাণপুর পোড়া বস্তিতে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার থাকে। শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে প্রতিটি পরিবার চার দিনের খাদ্যসামগ্রী পেয়েছিল।সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে দেওয়া সরকারি ত্রাণ পেয়েছে ৩০০ পরিবার। বস্তিটির সিবিওর সাধারণ সম্পাদক মো. হান্নান আকন্দ UK বাংলা News কে বলেন, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় নেই। কেউ তিনবার পাচ্ছেন, কেউ একবারও না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ভাসমান মানুষজকে নির্দিষ্ট আশ্রয়ে রেখে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা দরকার, আর নিম্ন আয়ের মানুষকে নগদ টাকা বা ভাউচার দেওয়া যায়।
কয়েকজন কাউন্সিলর এবং করপোরেশনের কর্মকর্তা জানান, কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে দুর্গত ব্যক্তিদের তালিকা করার জন্য কমিটি আছে। তবে নঈম ওয়ারার মতে, দলীয়ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নিরপেক্ষ না হতে পারেন।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোরশেদও UK বাংলা News কে বলেন, কমিটিতে বস্তির সিবিও, বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি ও গণমান্য ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব দরকার। এখন সাতটি ওয়ার্ডে পাইলট–ভিত্তিতে কাউন্সিলদের নেতৃত্বে তেমন কমিটি করে নতুন তালিকা বানানো হচ্ছে। তার ভিত্তিতে সমন্বিত ত্রাণ দেওয়া হবে।
Leave a Reply