রাজধানীর গোপীবাগে শুক্রবার রাতে আন্তঃনগর ট্রেন বেনাপোল এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে প্রাণ গেছে দুই শিশুসহ চারজনের। দগ্ধ হয়েছে আরও সাতজন। এর মধ্যে চারজনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

এর আগে রাজধানীর ডেমরায় একটি যাত্রীবাহী বাসে ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি পিকআপে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া ঢাকা, কুমিল্লা ও রাজশাহীসহ কয়েকটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনাটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একইভাবে শোক জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনসহ কয়েকজন মন্ত্রী। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এ অগ্নিসহিংসতা যারা করেছে অবশ্যই তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। সঠিক বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ও রেলওয়ে পুলিশ এটিকে নাশকতা বলছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, ‘যাত্রীবেশে উঠে পরিকল্পিতভাবে ট্রেনটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে।’

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা দুদিনব্যাপী হরতালের আগের রাতে এ নাশকতার জন্য তাদেরই দায়ী করছেন অনেকে। তবে বিএনপি এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। আগুনে হতাহতের নিন্দা জানিয়ে এটিকে মানবতার পরিপন্থি হিংস্র ও নিষ্ঠুরতা উল্লেখ করে জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে দলটি।

ট্রেনটি বেনাপোল থেকে ঢাকা আসছিল। রাত ৯টার দিকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ঢোকার আগ মুহূর্তে গোপীবাগে এলে এতে আগুন লাগে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। রাতে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর থেকে মিডিয়া কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, রাত ৯টা ৫ মিনিটে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদের পর ধাপে ধাপে ৮টি ইউনিট পাঠানো হয়। রাত ১০টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস যুগান্তরকে জানান, ট্রেনটি রাত ৯টার পর কমলাপুর স্টেশনে প্রবেশ করার কথা ছিল। এর আগে গোপীবাগ রেললাইনে ট্রেনটির পেছনের তিনটি বগির আগের দুটি বগি ‘চ’ এবং ‘ছ’ বগিতে আগুন লাগে। সামনের পাওয়ারকার বগিতেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পাওয়ার কারের সামনে থাকা পরের বগিগুলো তৎক্ষণাৎ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ঢাকা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডার শহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, চ এবং ছ বগি দুটি একেবারেই পুড়ে গেছে। আরও দুটি বগি কমবেশি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাওয়ারকারও পুড়েছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের দুজন হলেন আসিফ মো. খান ও ডা. কৌশিক বিশ্বাস। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অমিত দেবনাথ। ছেলে বের হতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি বলে জানান দগ্ধ আসিফের বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক খান। তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। বর্তমানে তারা ঢাকার নারিন্দায় থাকেন।

আসিফ বলেন, তিনি ও তার স্ত্রী নাতাশা ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে ঘটনার শিকার হন। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর দরজা দিয়ে বের হতে না পেরে আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করি। সে সময়ে লোকজন আমাকে টেনে বের করতে পারলেও আমার স্ত্রী নাতাশা জেসমিন (২৫) বের হতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, নাতাশা ট্রেনে রয়ে গেছে এবং সেখানে মারা গেছে। তার বাবা বলেন, আমরা এখনো নাতাশাকে পাইনি। আবাসিক চিকিৎসক তরিকুল ইসলাম বলেন, আসিফের শরীরের ৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।

সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আগুন কয়েকটি বগিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঘটনার পরপরই এলাকাবাসী পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেন।

ট্রেনে আগুন লাগার সময় জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন এক ব্যক্তি। হাত বাড়িয়েছিলেন সাহায্যের জন্য, বের হতে পারেননি। তার অর্ধেক শরীর ট্রেনের জানালার বাইরে, অর্ধেকটা ভেতরে। ওই ব্যক্তিকে জানালা থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করেছেন অনেকে। তাকে উদ্ধার করতে যাওয়া একজন তার শরীরে স্পর্শ করতে গিয়ে হাত গরমে পুড়ে যায়। এরপর অনেকে বাঁশ দিয়ে তাকে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শত শত মানুষের চোখের সামনে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হন ওই যাত্রী। তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী মো. সোহাগ জানান, ওই লোকটি ট্রেনের জানালা দিয়ে হাত ও মাথা বের করে আহাজারি করছিলেন, ‘ভাই আমার স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচান।’ তাকে বেরিয়ে আসার কথা বললেও তিনি স্ত্রী-সন্তানকে বের করার জন্য বারবার আকুতি জানাচ্ছিলেন। এর পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে ওই ব্যক্তি মারা যান।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না থাকায় নেভানো যায়নি আগুন। শুধু তাদের চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়েছে। এমনকি আগুন লাগার প্রায় অনেক পরে ফায়ার সার্ভিস এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ফারুক হোসেন বলেন, আমরা এলাকাবাসী, যখন আগুন লেগেছে দৌড়ে এসেছি। যার কাছে যতটুকু পানি ছিল আমরা সেভাবে চেষ্টা করেছি, কিছুই করতে পারিনি।

ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে খুঁজছেন : ‘ছোট ভাইয়ের বউকে খুঁজে পাচ্ছি না, বাচ্চাকে নিয়ে ওর মামা নেমে গেছে। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী কোথায় আছে কীভাবে আছে জানি না!’ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন সৈয়দ মুরাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ভাই সাজ্জাদ হোসেনের স্ত্রী, ছেলে, শ্যালক মিলে কয়েকজন রাজবাড়ী থেকে ট্রেনে উঠেছিল। আগুন লাগার পর আমার ছোটভাইকে ফোন দিয়ে বলেছে, ‘বিপদে আছি। আমার বাচ্চাকে নিয়ে ওর মামা নেমে গেছে।’ এরপর আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। মুরাদ হোসেন বলেন, তারা রাজবাড়ী থেকে আসছিলেন। ১৫ দিন আগে তার বাবা মারা গেছেন। আজ ঢাকায় ফিরছিলেন। পাঁচ মাস বয়সি আরফান সুস্থ আছে।

৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : বেনাপোল এক্সপ্রেস (৭৯৫) ট্রেনে আগুনের ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। শুক্রবার রাতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিরাজ-উদ-দৌলা খান জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী মো. সৌমিক শাওন কবিরকে প্রধান করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

যা বললেন র‌্যাব কর্মকর্তা : বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। শুক্রবার রাতে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন। মঈন বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, নাশকতাকারী বা দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে থাকতে পারে। আমরা এটা পর্যালোচনা করছি। গোয়েন্দারা এটি নিয়ে কাজ করছেন। যারা যাত্রী ছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে, এটি আদৌ নাশকতা কিনা বা দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে কিনা।

বিএনপির বিবৃতি : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিবৃতিতে বলেন, ‘গত ২০১৪ ও ১৫ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন অগ্নিসন্ত্রাসের নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মদদপুষ্ট দুষ্কৃতকারীরা জনদৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দেওয়া আগুনের ঘটনাসহ সম্প্রতি সেই মনুষ্যত্বহীন প্রাণবিনাশী অগ্নিসন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। আজকে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে হতাহতের ঘটনার দ্বারা সেই পুরনো কৌশলকেই ব্যবহার করা হয়েছে।’

রিজভী আরও বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ জনসমর্থিত হওয়ায় এর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন মহল দিশেহারা হয়ে গভীর চক্রান্ত ও নাশকতার ওপর ভর করেছে। এই অমানবিক ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। পৃথিবীর সব স্বৈরাচারই ভিন্নমতকে দমন করার জন্য সন্ত্রাস ও নাশকতার পন্থা অবলম্বন করে থাকে। দেশে-দেশে স্বৈরশাহী মানবতাবোধশূন্য ও অনুভূতিহীন হয়ে থাকে। আজকে দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগিয়ে যে ধ্বংস ও বিপদের পথ উন্মোচন করা হলো তাতে দেশ ও জাতিকে এক গভীর খাদের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা এই ঘটনায় জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করছি।’

এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনে এক নারী ও তার শিশু-সন্তানসহ চারজন দগ্ধ হয়ে মারা যান। ওই ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছিলেন, যাত্রীবেশে ট্রেনে উঠে আগুন দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।

বাসে আগুন : এদিকে রাত সোয়া ৯টায় রাজধানীর ডেমরার আমুলিয়া এলাকায় রমজান পরিবহণের একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দুর্বৃত্তরা সন্ধ্যায় ফতুল্লার পঞ্চবটিসংলগ্ন বন বিভাগের অফিসের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কে একটি পিকআপে আগুন দেয়। পথচারীরা ছুটে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। খবর পেয়ে ফতুল্লা মডেল থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া জানান, অগ্নিসংযোগে জড়িত দুর্বৃত্তদের ধরতে কাজ করছে পুলিশ।

ককটেল বিস্ফোরণ : শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বারডেম-২ এর সামনে দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। রমনা পুলিশ বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, ওই সময়ের হাসপাতালের পাশের গলি থেকে কয়েকজন মিছিল বের করে। তাদের পুলিশ ধাওয়া দেয়। এরপর পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। তাদের কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

এর আগে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সামনে চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ঢাবির এএফ রহমান হলের এক শিক্ষার্থী জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের পাশে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সামনে প্রথমে টানা তিনটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। পরে আবার একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের বিষয়ে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আল আমিন বলেন, চারটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা জানা যায়নি। তবে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।