‘স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর বাচ্চাটারে নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ি। আত্মীয়-স্বজন কিছু সহায়তা করে। তিনি (আনসার) আমাদের জন্য তেমন কিছু রেখে যাননি। জানি না তিনি আর ফিরবেন কি না।’
গাড়িচালকসহ ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনার দুই বছর আগে ২০১০ সালের ১৬ এপ্রিল মোহাম্মদপুর থেকে গায়েব হন নাজমুল হক মুরাদ নামে পিরোজপুরের কাউখালী এলাকার এক তরুণ ঠিকাদার। তাঁর ভাই সিরাজুল হক লিপু , ঘটনার কয়েক দিন পর মোহাম্মদপুরে তুরাগ নদ থেকে একটি বিকৃত গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেটি মুরাদের বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষায় শনাক্ত হয়নি। এরপর কেটে গেছে ১১ বছর।
এমন অনিশ্চয়তার চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে দুই শতাধিক পরিবার। বেশির ভাগ পরিবারেরই উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হারিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন আগে। স্বজনদের খুঁজে তারা হয়রানি, ভয়ভীতিসহ বিভিন্ন অমানবিক অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হচ্ছে।
২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় যাওয়ার পথে সাভারের নবীনগর থেকে নিখোঁজ হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালীউল্লাহ ওয়ালীদ। ওয়ালীদের বড় ভাই সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ঘুরে অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি। ভাইয়ের সন্ধান চাইতে গিয়ে বিপদ দেখে এক পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।’
২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজার এলাকা থেকে নিখোঁজ হন কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন। তাঁকে হারিয়ে ১৫ বছরের মেয়ে আর পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে সংকটে পড়েছেন স্ত্রী নাসরীন জাহান। তিনি বলেন, একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। করোনায় সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর স্বামীর ব্যাংক হিসাবে কিছু টাকা আছে; কিন্তু তিনি জীবিত, না মৃত নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত টাকা তোলা যাচ্ছে না।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর ৬১৪ জন নিখোঁজ বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। জীবিত ও মৃত অবস্থায় ওই ব্যক্তিদের বেশির ভাগের খোঁজ মিললেও অন্তত ২০০ জন এখনো নিখোঁজ।
পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে গুমের ঘটনা কমে গেছে। চলতি বছরের সাত মাসে তিনজন এবং গত বছর মাত্র দুজন নিখোঁজ হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গুমের ঘটনা কমলেও আগের ঘটনাগুলোর রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় আইনের শাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করে তদন্ত এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারের দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা।
এমন এক পরিস্থিতিতে আজ ৩০ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম থেকে সবার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে গুমের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারটি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আসে এবং কাউকে গুম করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়। ২০১১ সাল থেকে ৩০ আগস্ট গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। সনদ অনুযায়ী, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির কোনো প্রকার হদিস না পাওয়া গেলে এবং সরকার, প্রশাসন বা প্রভাবশালীরা হত্যা করে মৃতদেহ লুকিয়ে ফেললে সেটি গুম বলে বিবেচিত হবে। চলতি মাসেই বাংলাদেশের ৮৬টি গুমের তথ্য তুলে ধরেছিল নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)। আজ গুম প্রতিরোধ দিবসে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনে বাংলাদেশে গুমের অভিযোগ নিয়ে ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
এর আগে জুন মাসে ‘গুম’ হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিস-অ্যাপিয়ারেন্স বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায়। ৩৪ জনের তালিকার বেশির ভাগ ব্যক্তিকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গুম প্রতিরোধ দিবসে গুম হওয়া সব ব্যক্তির পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি। আসক বিশ্বাস করে, একটি ন্যায় ও মানবাধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুমের মতো ঘৃণ্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ করতে হবে। গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’
গতকাল রবিবার আসকের এক বিবৃতিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা এবং গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করাসহ সরকারের কাছে ছয়টি দাবি তুলে ধরা হয়। অন্য দাবিগুলো হচ্ছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া; অভিযোগ দায়েরের জন্য একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা; দায়ীদের বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, গুমের শিকার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোকে অস্বীকার না করে বিচার নিশ্চিতে বিদ্যমান আইন কাঠামোতে পরিবর্তন আনা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছেও নিখোঁজদের খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান, পরিবারকে আইনগত সহায়তা দান এবং পরিবারগুলোর অভিযোগ নিয়ে জাতীয় শুনানির আয়োজন করার দাবি জানিয়েছে আসক।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, চলতি বছরের সাত মাসে ছয়জনকে গুমের অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এখনো তিনজন নিখোঁজ আছেন। গত বছর ছয়জনকে গুমের অভিযোগ মেলে। পরে চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, নিখোঁজ রয়েছেন দুজন। ২০১৯ সালে ১৩ জনের মধ্যে চারজন ফেরত এসেছেন। একজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। নিখোঁজ আটজন। ২০১৮ সালে নিখোঁজ হয়েছেন ৩৪ জন। এর মধ্যে দুজন ফেরত এসেছেন। ১৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকি ১৫ জনের এখনো হদিস নেই। আসকের ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, ৬১৪ জনকে অপহরণের পর গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া যায়। ৯৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ ছাড়া ফিরে আসেন ৫৭ জন। অন্যদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়নি।
Leave a Reply