যদিও ঢাকার সমাবেশটি কোথায় হবে, নয়াপল্টনে না সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে—তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে বিএনপি ও সরকারি দল এবং প্রশাসনের মধ্যে বিতর্ক চলছে। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চেয়ে দুই দফা লিখিত আবেদন দিলেও পুলিশ বিএনপিকে ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি এখনো নয়াপল্টনেই আছে। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানে নাগরিক মহলে বলাবলি হচ্ছে, সরকার কেন বিএনপিকে জোর করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঠাতে চাইছে। আবার বিএনপিও কেন নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার জেদ ধরে আছে। এ নিয়ে দুই পক্ষে যুক্তি–পাল্টাযুক্তি আসছে গণমাধ্যমে। এ অবস্থায় ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই আলোচনায় বাড়তি রসদ দিয়েছে সমাবেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিত থাকার গুঞ্জন।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সমাবেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিত থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ ধরনের দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনাও তাঁরা নেননি। তা ছাড়া খালেদা জিয়া শর্ত সাপেক্ষে জামিনে থাকলেও এখনো তিনি মুক্ত নন। তবে দলটির নেতারা মনে করেন, দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রকামী সর্বসাধারণ খালেদা জিয়ার মুখ থেকে কিছু শোনার প্রত্যাশা করছেন। এখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা এবং মন্ত্রীরা সমাবেশে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে যা বলছেন, সেটি অনুমান থেকেই বলছেন।
২৫ মাস কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়। যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণাসহ মানুষকে ঘরবন্দী করতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে, তখন তিনি শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। তখন থেকে খালেদা জিয়া গুলশানের ভাড়া বাসায় আছেন।
সমাবেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিত থাকার আইনগত কোনো সুযোগ আছে কি—এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, খালেদা জিয়া মুক্ত নন। যে কারণে তাঁর সাংবিধানিক এবং আইনগত অধিকার থাকা সত্ত্বেও উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে যেতে পারছেন না।
তাহলে সমাবেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিত থাকার কথাটি কীভাবে এল, আর কথাটির প্রচার কীভাবে ছড়াল?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সূত্রপাত হয় বিএনপির মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার বক্তব্যের রেশ ধরে। গত ৮ অক্টোবর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। এর এক দিন পর দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী লক্ষ্মীপুরে দলীয় কর্মসূচিতে বলেন, শিগগির তারেক রহমান দেশে আসবেন। তার পরদিন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক ঢাকার একটি পত্রিকাকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবে ‘আটলান্টিক মহাসাগরের’ মতো। এই সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা এ বক্তব্যগুলোকে সামনে এনে কথা বলা শুরু করেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-নেতারা। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশে খালেদা জিয়ার যাওয়া না-যাওয়ার আলোচনা অবাস্তব, উদ্ভট ও অলীক চিন্তা বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি, আদালত থেকে জামিন পাননি। এখন যদি তাঁরা (বিএনপি নেতারা) এ রকম চিন্তা করে থাকেন; তাহলে সরকার তাঁকে (খালেদা জিয়াকে) কারাগারে পাঠাতে বাধ্য হবে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে কারাগারের বাইরে আছেন এবং তিনি জনসভায় যোগ দিলে আদালত ব্যবস্থা নেবেন।
সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন, ওই বক্তব্যের বিষয়ে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘ওটা ছিল রাজনৈতিক বক্তব্য। তাঁরা (সাংবাদিক) আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখছি সমাবেশে খালেদা জিয়াও নাকি যাবেন। আমি বলেছি, আমিও দেখেছি, গেলেও যেতে পারেন। এটা দলের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’
৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়া নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এখনো তিনি সুস্থ নন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত খালেদা ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দী ছিলেন। প্রথমে তাঁকে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হলেও একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২৫ মাস কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়। যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণাসহ মানুষকে ঘরবন্দী করতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে, তখন তিনি শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। তখন থেকে খালেদা জিয়া গুলশানের ভাড়া বাসায় আছেন।
একটি রাজনৈতিক বক্তব্যকে সরকার ব্র্যান্ডিং করছে। আমরা মনে করি, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে বাড়াবাড়ির পথ তৈরি করা এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে।
গত ২৩ মার্চ জরুরি সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শর্ত হলো এ সময়ে খালেদাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। আর অলিখিত শর্ত হচ্ছে, এ সময় খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না।
খালেদা জিয়া ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশে উপস্থিত থাকতে পারবেন কি না, থাকলে কী হবে—তা নিয়ে কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। গতকাল শুক্রবার নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে উচ্চ আদালত খালেদা জিয়ার জামিন দেননি। আইনমন্ত্রী শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওনারা (বিএনপি নেতারা) বলেছেন ডিসেম্বরের ১০ তারিখে ওনাকে (খালেদা জিয়াকে) দিয়ে বক্তৃতা দেওয়াবেন। কিন্তু ওনাদের আবেদনে ছিল, তাঁর শারীরিক অবস্থা এত খারাপ, তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁকে অবশ্যই তাড়াতাড়ি মুক্তি দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। তাহলে যদি খালেদা জিয়া ১০ তারিখে যান, তাহলে ওই যে দরখাস্ত, যে লেখা ছিল—সেটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে না?’
বিএনপির নেতারা বলছেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিত থাকার বক্তব্যটি ছিল রাজনৈতিক। কর্মসূচির ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে মধ্যম সারির কয়েকজন নেতা এ কথাটি বলেছিলেন। যদিও এ ধরনের বক্তব্যের জন্য বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ওই তিন নেতাকে ভর্ৎসনা করা হয়। তাদের লক্ষ্য ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ শেষে ঢাকার এই সমাবেশ থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু সরকার এই সমাবেশ নিয়ে দলের মধ্যম সারির কয়েক নেতার বক্তব্যকে অজুহাত করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভ্রান্তিকর প্রচারে নেমেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘এটা হলো ইস্যু সৃষ্টির জন্য অজুহাত তৈরি করা। এ কারণে একটি রাজনৈতিক বক্তব্যকে সরকার ব্র্যান্ডিং করছে। আমরা মনে করি, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে বাড়াবাড়ির পথ তৈরি করা এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে।’
Leave a Reply